সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ
صحيفة همام بن منبه
সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ এ কিতাবটি সহীহ বোখারী ও সহীহ মুসলিমের মতই সহীহ। বরং বলা যায়, সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ বর্তমান সময়ে আমাদের হাতে থাকা সহীহ হাদীসের সংকলন সমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রাচীন সংকলন। কারণ হাম্মাম রহিমাহুল্লাহ উনি প্রবীণ তাবেঈ। তিনি সবগুলো হাদিস সরাসরি আবু হুরায়রা থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন। আর আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে।
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু সম্পর্কে ইমাম বুখারি (রহ.) বলেছেন যে, আবু হুরাইরা (রা.) এর কাছ থেকে প্রায় ৮০০ বা তার বেশি সাহাবী, তাবেয়ী এবং অন্যান্য মনীষী হাদীস বর্ণনা করেছেন। কথিত আছে, তার সুনিপুণ স্মৃতিশক্তির কারণেই তাঁকে ‘আবু হুরাইরা’ (বিড়ালের বাবা) ডাকা হতো, অর্থাৎ বিড়াল যেমন তার পরিচিত স্থান কখনো ভুলে না, তেমনি তিনিও কোনো কিছু ভুলতেন না।
ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবু হুরাইরা (রা.) বলেছিলেন: লোকেরা বলে যে, আবু হুরাইরা অনেক হাদীস বর্ণনা করে। যদি আল্লাহর কিতাবে দুইটি আয়াত না থাকত, আমি কোনো হাদীসই বর্ণনা করতাম না। এরপর তিনি এই আয়াত দুটি পাঠ করেন:
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡتُمُوۡنَ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا مِنَ الۡبَیِّنٰتِ وَالۡہُدٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا بَیَّنّٰہُ لِلنَّاسِ فِی الۡکِتٰبِ ۙ اُولٰٓئِکَ یَلۡعَنُہُمُ اللّٰہُ وَیَلۡعَنُہُمُ اللّٰعِنُوۡنَ ۙ اِلَّا الَّذِیۡنَ تَابُوۡا وَاَصۡلَحُوۡا وَبَیَّنُوۡا فَاُولٰٓئِکَ اَتُوۡبُ عَلَیۡہِمۡ ۚ وَاَنَا التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ
নিশ্চয়ই যারা আমার নাযিলকৃত উজ্জ্বল নিদর্শনাবলী ও হিদায়াতকে গোপন করে, যদিও আমি কিতাবে তা মানুষের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছি, তাদের প্রতি আল্লাহ লানত বর্ষণ করেন এবং অন্যান্য লানতকারীগণও লানত বর্ষণ করে। তবে যারা তাওবা করেছে, নিজেদেরকে সংশোধন করেছে এবং (গোপন করা বিষয়গুলো) সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছে, আমি তাদের তাওবা কবুল করে থাকি। বস্তুত আমি অতিশয় তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। (সূরা আল-বাকারা ২: ১৫৯-১৬০)।
আবু হুরাইরা (রা.) আরও বলেন: “আমাদের মুহাজির ভাইরা বাজারে ব্যস্ত থাকতেন আর আমাদের আনসার ভাইরা তাঁদের জমিজমার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। আর আবু হুরাইরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে থাকতো, কোনরকম পেটে কিছু দানাপানি ফেলে, ফলে তারা যেসব মজলিসে উপস্থিত থাকতো না আবু হুরায়রা সেখানে উপস্থিত থাকতো এবং তারা যেগুলো মনে রাখত না আবু হুরায়রা সেগুলো মনে রাখতো।
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহুর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। মারওয়ান ইবনুল-হাকাম একবার আবু হুরাইরা (রা.)-কে পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি তাকে ডেকে পাঠালে তিনি আসলেন। মারওয়ান আগেই একজন লেখককে পর্দার পেছনে বসতে আদেশ দিয়েছিলেন। তারপর মারওয়ান আবু হুরাইরাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন, আর আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু যা জানতেন তা বলতে লাগলেন। লেখক বলেন: “তিনি প্রশ্ন করছিলেন আর আমি অনেক হাদীস লিখে নিচ্ছিলাম।” আবু হুরাইরা (রাঃ) বুঝতেই পারেননি পর্দার পেছনে কী ঘটছে, তারপর তিনি চলে যান। এক বছর পর মারওয়ান আবার তাঁকে ডাকেন। লেখক বলেন, এক বছর পর মারওয়ান আবার তাঁকে ডাকেন এবং আমাকে আবার পর্দার পেছনে বসান। এবারও মারওয়ান তাঁকে প্রশ্ন করতে থাকেন আর আমি পূর্বের লেখাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে থাকি—কিন্তু আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু সামান্যও কমবেশি করেননি।
এই ঘটনা শুধু এটাই প্রমাণ করে না যে, আবু হুরাইরার (রাঃ) এর অসাধারণ স্মরণশক্তি ছিল, বরং সাথে এটাও প্রমাণ করে যে, তাঁর কিছু হাদীস মারওয়ানের আদেশে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং তার কাছ থেকে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
বর্ণিত আছে, আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু ইবনে ওহাবকে তার গ্রন্থাবলী দেখিয়েছিলেন। দারেমী (রহ.) আবু হুরাইরা (রা.)-এর আরেকটি সংকলনের কথা বর্ণনা করেছেন, যেখানে তিনি বলেন: “বশীর ইবন নাহিক বলেছেন, আমি যা কিছু আবু হুরাইরা (রা.) থেকে শুনেছি, তা লিখে রাখতাম। যখন আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় এল, আমি লিখিত পাণ্ডুলিপি তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম, এবং পড়ে শুনিয়েছিলাম। আর বললাম, এটি আপনার কাছ থেকে শোনা সবকিছু। তিনি বললেন, হ্যাঁ।”
ইবন আব্দুল বার আবু হুরাইরার (রাঃ) জীবনের শেষ সময় সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি ইবনে আমর ইবনে উমাইয়া আয-যমরী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন:
আমি আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করলাম। তিনি তা অস্বীকার করলেন। আমি বললাম: আমি তো আপনার থেকেই এটি শুনেছি। তিনি বললেন: যদি তুমি আমার কাছ থেকে শুনে থাকো, তবে নিশ্চয়ই তা আমার কাছে লেখা আছে। তারপর তিনি আমার হাত ধরে নিজ ঘরে নিয়ে গেলেন এবং আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বহু হাদীসের লিপিবদ্ধ পুস্তক দেখালেন। সেখানে সেই হাদীসটিও পাওয়া গেল। তখন তিনি বললেন: আমি তো বলেছিলাম, যদি আমি তা বলে থাকি, তবে তা নিশ্চয়ই আমার কাছে লিখিত রয়েছে। (সূত্র: جامع بيان العلم, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৭৪)
আবু হুরাইরা (রাঃ) এর আরও অনেক ছাত্র ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হাম্মাম ইবন মুনাব্বিহ, যিনি আমাদের আলোচ্য পুস্তিকা "সহীফায়ে হাম্মাম" সংকলন করেছিলেন। এটি প্রাচীনতম হাদীস সংকলনগুলোর একটি, যা আজও বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।
হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ
হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ সম্পর্কে ইবনু হাজার 'তাহযীবুত তাহযীব' গ্রন্থে লিখেছেন:
হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ ইবনে কামিল ইবনে শাইখ আল-ইয়ামানি, তাঁর উপনাম ছিল আবু উক্ববা। তিনি ছিলেন সানআ' নগরের (সনআনি) অধিবাসী এবং "আল-আবনা" গোত্রভুক্ত। [“আল-আবনা” হচ্ছে ওইসব পারসিক, যারা ইসলাম-পূর্ব যুগে কিসরা (ফারসি সম্রাট) যখন ইয়েমেন জয় করেন তখন সেখানে বসতি স্থাপন করে।]
তিনি হাদীস বর্ণনা করেছেন:
- আবু হুরায়রা,
- মুয়াবিয়া,
- ইবনে আব্বাস,
- ইবনে উমর,
- ও জুবাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে।
তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন:
- তার ভাই ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ,
- ভাতিজা আকীল ইবনে মাকিল ইবনে মুনাব্বিহ,
- আলী ইবনে হাসান ইবনে আতশ,
- এবং বিখ্যাত মুহাদ্দিস মা‘মার ইবনে রাশিদ।
ইসহাক ইবনে মানসুর, ইবনে মা‘ঈনে এ কথা উদ্ধৃত করেছেন যে: “তিনি বিশ্বস্ত (ثقة) ছিলেন।”
ইবনে হিব্বান তাঁকে তাঁর "الثقات" গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
মাইমুনি, ইমাম আহমদ থেকে বর্ণনা করেছেন: “তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন এবং তাঁর ভাই ওহাবের জন্য বই সংগ্রহ করতেন। তারপর তিনি আবু হুরায়রার সংস্পর্শে এসে হাদীস শুনেন। এই হাদীসগুলো প্রায় ১৪০টি আর সবগুলোই একটি একক সনদে ছিল। যখন হাম্মাম বৃদ্ধ হয়ে পড়েন এবং তাঁর ভ্রু চোখের ওপর পড়ে যেত, তখন মা‘মার তাঁর কাছে হাদীস পাঠ করতে গিয়েছিলেন। হাম্মাম যখন ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়তেন তখন মা‘মার বাকিটা নিজেই পাঠ করে নিতেন। মা‘মারের বিশিষ্ট শাগরেদ আব্দুর রাজ্জাক এসম্পর্কে বিস্তারিত জানতেন না যে, কোনটা হাম্মাম নিজে পড়েছেন আর কোনটা মা’মার তাকে পড়ে শুনিয়েছে।
ইবনে সা‘দ (রহ.) বলেন, তিনি ১৩১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
বুখারী (রহ.) আলী ইবনুল মাদীনীর এ কথা উদ্ধৃত করেছেন যে, “হাম্মামকে দেখেছিলেন এমন একজন ব্যক্তিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, হাম্মাম কবে ইন্তেকাল করেছেন? তিনি বললেন, হাম্মাম ১৩২ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
ইবনে উয়াইনাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি দশ বছর যাবৎ আশায় আশায় ছিলাম যে হাম্মামের আগমন ঘটবে।
ইবন সাদ (রহ.) খলীফা (রহ.) ও ইবনে হিব্বান (রহ.) বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ১৩১ বা ১৩২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ই’জলী বলেন, "তিনি ছিলেন একজন ইয়ামানি তাবেয়ী এবং নির্ভরযোগ্য।” (এপর্যন্ত ইবনে হাজার আল-আসকালানি (রহ.) এর কথা শেষ।)
"কাশফুয-যুনুন" গ্রন্থের লেখক বলেছেন, "আস-সহীফাহ আস-সদিকাহ সানআনী শাইখ হাম্মাম ইবন মুনাব্বিহ (রহ.) এর, তিনি ১৩১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। তিনি কিতাবটিতে আবু হুরাইরা (রা.) থেকে শোনা হাদীসগুলো সংকল করেছেন।"
তো কাশফুয-যুনুন গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী হাম্মাম (রহ.) আবু হুরাইরা (রা.) এর সান্নিধ্যে ছিলেন এবং তার কাছ থেকে হাদীস শোনার পর সেগুলো নিয়ে একটি সঙ্কলনে তৈরি করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন "আস-সহীফাহ আস-সদিকাহ"। এ যেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিআল্লাহু আনহুর "সাহিফা সাদিকাহ" এর মতোই। হাম্মামের কিতাবটি হাম্মামের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন তার শিষ্য 'মামার'। তার কাছ বর্ণনা করেছেন আব্দুর রাযযাক। তারপর এই ধারা এভাবেই অব্যাহত আছে। সে হিসেবে বলা যায়, এই সঙ্কলনটি প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি হয়েছিল, কারণ আবু হুরাইরা (রা.) ৫৮ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.) তার "মুসনাদ" এ এই সঙ্কলনের সমস্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন (মুসনাদ ২, পৃ. ৩১২-৩১৯)। ইমাম বুখারি (রহ.)ও তাঁর "সহীহুল বুখারী" তে বিভিন্ন অধ্যায়ে এই সঙ্কলনের বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া এই সঙ্কলনটি তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুতাওয়াতিরভাবে চলে আসছে। মুদ্রিত পাণ্ডুলিপিতেও আলাদা আলাদা সনদ রয়েছে।
বুখারী রহিমাহুল্লাহ সহীহ বুখারীতে যতটুকু উদ্ধৃত করেছেন তার সাথেও মিলিয়ে দেখা হয়েছে। তিনি অবশ্য হাদীসগুলোকে বিভিন্ন অধ্যায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এনেছেন। আর ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল সব হাদীস একসাথে তুলে ধরেছেন। যখন আমরা ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের "মুসনাদ" এর ওই অধ্যায়ের সাথে আমাদের কাছে থাকা পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে দেখি, তখন আমরা লক্ষ্য করি, মুসনাদের সাথে উভয় পান্ডুলিপির ক্রমান্বয় হুবহু মিলে যায়। মাত্র দুই বা তিন স্থানে ভিন্নতা দেখা যায়। তেমন কোনো শব্দের কমবেশিও নেই। (দেখুন: ‘ছহীফা’তে উল্লেখিত নিম্নোক্ত হাদীসসমূহ ১৩, ৯৩, ১২৬, ১৩৮)।
মোটকথা হাম্মামের সঙ্কলিত হাদীস শুধু তার পাণ্ডুলিপিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং অন্যান্য আরো অনেকেই তা বর্ণনা করেছেন। এগুলি আমরা ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.) এর "মুসনাদ", সহীহ বুখারি এবং অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে পেয়েছি, যার মধ্যে কিছু হাদীস হুবহু আবু হুরাইরা (রহ.) থেকে আর কিছু অন্যান্য সাহাবীদের থেকেও বর্ণিত হয়েছে।